রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০২:৫৫ পূর্বাহ্ন
আবদুল আজিজ:
মিয়ানমারের রাখাইনের ‘বলিবাজার’ এখন বাংলাদেশে গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের আদলে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে গড়ে উঠা এই ‘বলিবাজার’-এ প্রতিদিনি চলে কোটি টাকার বানিজ্য। স্বর্ণের অবাধ বেচা-কেনা থেকে শুরু করে কাপড়, কসমেটিক, মোবাইল ও নানা ইলেক্ট্রনিক্সের বড় বড় দোকান। আর এসব দোকানে কোটি টাকার বেচা-বিক্রি হলেও সরকারকে দিতে হয় না কোন রাজস্ব। অবশ্য, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বলছেন, রোহিঙ্গাদের এসব দোকানগুলো পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করা হবে। বিশেষ করে স্বর্ণের দোকান, মোবাইল ও কম্পিউটারের দোকান গুলোতে প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ অভিযান চলছে।
রোহিঙ্গাদের দেয়া তথ্যমতে, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মংডু টাউনশীপের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ‘বলিবাজার’। বাংলাদেশের নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম সীমান্তের ৫ কিলোমিটার পূর্বে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ঐতিহ্যবাহি এই ‘বলিবাজার’ ষ্টেশন। রাখাইনের এই অঞ্চলে বসবাসরত রোহিঙ্গা ছাড়াও স্থানীয় মগদের প্রধান বেচা-কেনার কেন্দ্রস্থল এই ‘বলিবাজার’ একমাত্র ভরসা। নিয়মানুযায়ী এই ‘বলিবাজার’কে ঘিরে মিয়ানমার সরকার প্রতিবছর কোটি টাকার (কিয়েট) রাজস্ব আদায় করে। কিন্তু, গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে রাখাইনে মিয়ানমারের সরকারের সেনাবাহিনীর অব্যাহত বর্বর ও ভয়াবহ নির্যাতন এবং গণত্যার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাড়ে ৭ লাখেরও বেশী রোহিঙ্গা। নতুন-পুরনো মিলে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে এখন ১১ লাখেরও বেশী রোহিঙ্গাদের অবস্থান। আর এসব রোহিঙ্গাদের বেশীরভাগ উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালীতে। সেই বালুখালীর পানবাজার থেকে একটু পশ্চিমে যেতেই চোখে পড়ে রোহিঙ্গাদের গড়ে তোলা ‘বলিবাজার’। অবশ্য, এই ‘বলিবাজার’-এ স্থানীয় কোন বাংলাদেশীদের ঠাই নেই। কোন বাংলাদেশী এই ‘বলিবাজার’-এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করলেও রোহিঙ্গারা ওই দোকান থেকে কোন ধরণের লেনদেন করেনা।
রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীরা জানান, ‘মিয়ানমারের রাখাইনের ‘বলিবাজার’-এ যেসব ব্যবসায়ীদের দোকান ছিল, মুলত; তাদের বেশীরভাগ অংশ এই ‘বলিবাজার’কে ঘিরে। এই ‘বলিবাজার’-এ প্রতিদিন কোটি টাকার লেনদেন হয়। কিন্তু, সরকারকে কোন ধরণের রাজস্ব দিতে হয় না। তবে স্থানীয় জমি ও মার্কেটের মালিককে প্রতিমাসে ভাড়া আদায় করলেই সব মাফ।
রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ফয়সাল (২৬)। মিয়ানমারের রাখাইনের ‘বলিবাজার’-এ তার বিশাল কাপড়ের ব্যবসা ছিল। কিন্তু, ২০১৭ সালে রাখাইনে সে দেশের সেনাবাহিনীর অস্ত্রেরমুখে প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে চলে আসে। সেনাবাহিনী লুট করে নিয়ে যায় তার দোকানের সব মালামাল। পরে আশ্রয় হয় উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এখন মিয়ানমারের আদলেই গড়ে তুলেছে বিশাল কাপড়ের ব্যবসা। স্থানীয় গফুর উদ্দিনের মালিকানাধীন জমিতে এখন বিশাল কাপড়ের মার্কেট। তার দোকানে প্রতিদিন ১০লাখ টাকার উপরে বেচা-কেনা হয়।
ফয়সাল আরও জানান, ‘মিয়ানমারের বলিবাজারের বেশীরভাগ ব্যবসায়ী এখন বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দোকান গড়ে তুলেছে। এ কারণে তার এই বাজারের নাম দিয়েছে ‘বলিবাজার’। এটি মিয়ানমার একটি স্টেশনের নাম হলেও এখন বালুখালী ‘বলিবাজার’ নামে বেশ পরিচিত।’
রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী বৃদ্ধ আবদুর রশীদ কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘মিয়ানমারের বলিবাজারের তার জুতার দোকান ছিল। আর এখন বালুখালীর ‘বলিবাজার’-এ একই রকম জুতার দোকান গড়ে তুলেছি। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের এই ‘বলিবাজার’ নামে পরিচিত পাওয়ায় দুর-দুরান্ত থেকেও গ্রাহকরা এখানে ভিড় জমায়। এক্ষেত্রে কোন ধরণের রাজস্ব দিতে হয় না।’
শুধু ফয়সাল ও আব্দুর রশীদ নয়, তাদের মতো শত শত ব্যবসায়ীদের দোকান রয়েছে এই ‘বলিবাজার’-এ। এই বাজারের গ্রাহকও রোহিঙ্গা। এখানে কোন ধরণের স্থানীয় গ্রাহক না থাকায় কোন বাংলাদেশী ব্যবসা করলেও সফলতা আসে না। কারণ, রোহিঙ্গারা আঞ্চলিকতার টানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বেচা-কেনা করে। তবে যে সব দোকানদার এই ‘বলিবাজার’-এ ব্যবসা করছে, তাদের রোহিঙ্গা কর্মচারি দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। একইভাবে স্বর্ণের দোকান গুলোতেও একই অবস্থা। দোকানে রোহিঙ্গা কর্মচারি না থাকলে বেচা-কেনা খুবই কম। এজন্য বাধ্য হয়ে রোহিঙ্গা কর্মচারি রাখতে হয়ে তাদের। শুধু বালুখালী ‘বলিবাজার’ নয়, পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্প জুড়ে বিভিন্ন অলিগলিতে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে স্বর্ণের দোকান। এসব স্বর্ণের দোকানে চোরাইপথে আসা মিয়ানমারের স্বর্ণ বিক্রি হয় কোটি কোটি টাকার।
উখিয়ার বালুখালীর স্থানীয় যুবক মুফিজ উদ্দিন কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে আমরা আস খুবই অসহায়। ক্যাম্পে আমরা কোন ব্যবসা করতে পারি না। সব রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। আমরা স্থানীয়রা কোন দোকান করলেও রোহিঙ্গারা আমাদের এখানে আসে না। তাই, অনেকের ব্যবসা বানিজ্য এখন বন্ধ। এছাড়াও মিয়ানমারের বলিবাজারের নামে এখনে ‘বলিবাজার’ গড়ে উঠায় আমাদের বাজারের মধ্যে ব্যবসা করতে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে’।
উখিয়ার বালুখালীর স্বর্ণ ব্যবসায়ী কেশব ধর কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে স্বর্ণের দোকান। এসব দোকানে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে মিয়ানমারের স্বর্ণ। বাংলাদেশে তৈরী যত ভাল স্বর্ণ হউক রোহিঙ্গারা নিতে চাই না। রোহিঙ্গাদের শুধু মিয়ানমারের তৈরী স্বর্ণের চাহিদা বেশী। এছাড়াও রোহিঙ্গা কর্মচারি না থাকলে রোহিঙ্গারা দোকানের ধারে কাছেও আসে না।’
জানত চাইলে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসু দৌজা নয়ন কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বর্ণের দোকান গুলো প্রশাসনের নজরে রয়েছে। ইতিমধ্যে বেশকিছু দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে। আরও উচ্ছেদ করা হবে, এটি চলমান রয়েছে’।
ভয়েস/আআ